বাংলাদেশের বাংলা ভাষাপরিস্থিতি – DW – 11.02.2019
  1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বাংলাদেশের বাংলা ভাষাপরিস্থিতি

মোহাম্মদ আজম
১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

দেশভাগের পরে পশ্চিমবাংলার বাংলা ভাষা নানা ধরনের চাপে পড়েছে৷ এর মধ্যে আছে ইংরেজি ও হিন্দির চাপ, আছে রাষ্ট্রযন্ত্র, উৎপাদনসম্পর্ক আর সচ্ছল মধ্যবিত্তের অন্দরে ঢুকতে না-পারার চাপ৷

https://p.dw.com/p/3D3Ep
Internationaler Tag der Muttersprache Bangladesch
ছবি: AP

এর ফলে ওখানে বাংলা ভাষার প্রগতিশীলতার সম্ভাবনা কমেছে বলেই মনে হয়৷

ভাষার প্রগতিশীলতা বলতে এখানে কী বোঝাচ্ছি, তা খুলে বলা দরকার৷ প্রথমত, মুখের ভাষার সাথে প্রতিনিয়ত আপোশরফা করে প্রাণবান আর গতিশীল থাকা৷ নতুন ধারণা প্রকাশ করার জন্য ভাষার বিপুল কথ্যভাণ্ডারে নিয়মিত তল্লাশি চালানো, আর বিপরীতে কথ্য দুনিয়ার শব্দে নতুন ভাবের মুখোমুখি হলে সেই ভাব আর সংশ্লিষ্ট ভাষাভঙ্গি আত্মসাৎ করে নেয়া৷ দ্বিতীয়ত, ক্ষমতা-সম্পর্কের উঁচু জায়গাগুলোতে ব্যবহৃত হওয়া৷ এইরকম জায়গা আছে মোটামুটি তিনটি : প্রশাসন, আদালত আর শিক্ষা৷

এসব কথা যদি ঠিক হয়, তাহলে খুব সহজেই অনুমান করা যায়, বাংলা ভাষার প্রগতির সম্ভাবনা বাংলাদেশেই বেশি৷ কিন্তু তা হয়ে ওঠেনি৷ কারণ, পাকিস্তান রাষ্ট্র ও সংশ্লিষ্ট ‘পাকিস্তানি বাংলা' বা ‘মুসলমানি বাংলা' বলে এক জগাখিচুড়ি ফলিয়ে তোলার ব্যাপারে একটা সময়ের চেষ্টা৷ সেই চেষ্টা বোধগম্য কারণেই ব্যর্থ হয়েছে৷ কিন্তু তার ভূত আমাদের প্রতিনিয়ত তাড়া করে ফেরে৷ বাংলাদেশে বাংলা ভাষা সংক্রান্ত বিপুল আলোচনায় এ লক্ষণ দেখা যায়৷ ফলে বাংলাদেশে বাংলা ভাষার কাঙ্ক্ষিত প্রগতি সম্ভবপর হয়নি৷ পশ্চিমবাংলা ও বাংলাদেশের অনেক ভাষ্যকার দেখিয়েছেন, বাংলাদেশের বাংলাচর্চা পশ্চিমবাংলার তুলনায় অনেক রক্ষণশীল৷ ব্যাকরণ-অভিধান তো বটেই, এমনকি পত্রপত্রিকার ভাষায়ও সে রক্ষণশীলতা নিত্য চোখে পড়ে৷

এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার৷ পশ্চিমবাংলার বাংলা মরে যাচ্ছে, আর বাংলাদেশের বাংলা বেশ তাজা আছে– এ ধরনের মন্তব্যে বাংলাদেশের কোনো কোনো পণ্ডিতকে আত্মপ্রসাদ লাভ করতে দেখি৷ এর কোনো বাস্তবতা আছে বলে মনে হয় না৷ এটা ঠিক, বাংলাদেশের বাংলায় প্রাণশক্তি আর বৈচিত্র্য পশ্চিমবাংলার তুলনায় বেশি৷ কিন্তু যুক্তিশীলতার চর্চা আর জ্ঞানচর্চাকে ভাষায় বাগ মানানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চর্চা তো পশ্চিমবাংলার সাথে এক পাল্লায় উঠতেই পারবে না৷ ভাষার ক্ষেত্রে ‘প্রগতিশীল' চর্চায় আগুয়ান হতে পারলে বাংলাদেশের বাংলা বোধ করি পশ্চিম বাংলার বাংলার জন্যও কিছু সারবস্তুর জোগান দিতে পারত৷ কিন্তু তার কোনো লক্ষণ আজতক দেখা যায়নি৷

আমরা বরং বর্তমানে, প্রায় দু-তিন দশক হলো, লিপ্ত আছি প্রমিতপক্ষীয় আর প্রমিতবিরোধীদের তিক্ত বাগবিতণ্ডায়৷ প্রমিতপক্ষীয়রা পুরাতন প্রমিতের ভাষারূপ এবং ব্যাকরণবিধি হুবহু সংরক্ষণ করতে চান৷ আর বর্তমানে চালু ‘মানভাষা'র বিরোধিতা করতে গিয়ে অনেকে ‘মানভাষা'র ধারণারই বিরোধিতা করেন৷ ভাষার ব্যবহারজনিত ব্যাপকতা সম্পর্কে কাণ্ডজ্ঞানহীনতাই এই বিরোধিতার কারণ৷ রাষ্ট্র একটি বিরাট কাঠামো, এর ভিতরে আছে আরো বহু ধরনের কাঠামো আর সামষ্টিকতা৷ মানে দশের কারবার৷ দশের কারবারের জন্য দরকার সেই ভাষা, যাতে দশের সম্মতি আছে৷ এই বস্তুর নামই ‘মানভাষা'৷ এই নামে আপত্তি থাকলে একে অন্য নামেও ডাকা যেতে পারে; কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক ভাষার ব্যাপারে সম্মতি প্রতিষ্ঠা করতেই হবে৷

মুশকিল হলো, ভাষার কারবার বলতে আমরা আজও প্রধানত সাহিত্য বুঝি৷ এই ব্যারাম বাঙালির মধ্যে ভর করেছিল উপনিবেশ আমলে– উপনিবেশিত্বের খাসলত অনুযায়ী৷ তখন রাষ্ট্র চালানোর বা রাজনীতি করার সুযোগ না থাকায় জোরটা পড়েছিল শিল্পসাহিত্য এবং সমাজ-সংস্কারের মতো কর্মকাণ্ডে৷ শ্যামাচরণ গাঙ্গুলি, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আর অনেকাংশে রবীন্দ্রনাথ–এই কয়জনকে পাই, যাঁরা বুঝতেন, সাহিত্য ভাষার একটা ছোট্ট দিক মাত্র৷ জনশিক্ষা থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পরিচালনা পর্যন্ত অসংখ্য সামষ্টিক কাজকে–যার সাথে সমস্ত মানুষ জড়িত– পাত্তা না দিয়ে সাহিত্যচর্চাকে ভাষা-সম্পর্কিত বিবেচনার কেন্দ্রে স্থান দেয়া কেবল বোকামি নয়, ক্ষতিকরও বটে৷ ঢাকার প্রমিতপন্থি ও প্রমিতবিরোধীদের প্রবণতা এই দোষমুক্ত নয়৷

আমাদের চালু ‘প্রমিত' বাংলার মূল সমস্যা, বলা যায়, গোটা তিনেক৷

এক. ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতার কারণে মানভাষা নির্ধারণের ক্রমটি একেবারে উলটে গিয়েছিল৷ মুখ থেকে কলমে না এসে ভাষা কলম থেকে মুখে এসেছিল৷ ফলে প্রথম থেকেই জনবিচ্ছিন্নতার বাড়তি চাপ একে পুষ্টির অভাবে ফেলেছে৷

দুই. এই ‘প্রমিত' স্থির করা হয়েছিল কলকাতায়, এবং কলকাতার ভাষাকে কেন্দ্র করে৷ ওই বস্তু ঢাকায় উড়ে এসে জুড়ে বসেছে৷ কলকাতায় বাংলার সমৃদ্ধ চর্চা হয়েছে৷ এর কায়দা-কানুনও যথাসম্ভব বিধিবদ্ধ হয়েছে৷ সেগুলোকে সাধ্যমতো কাজে লাগিয়ে পূর্ব বাংলার ভাষার স্পষ্টভাবে শনাক্তযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলোকে পাত্তা দিয়ে ‘প্রমিত' ভাষায় সম্মতির হার বাড়ানো যেতো৷ কিন্তু তা হয়নি৷ এখানে একটা কথা উল্লেখ করা দরকার– পূর্ব বাংলার ভাষার, মানে বাঙালদের ভাষার, বহু পৃথক বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ রবীন্দ্রনাথসহ বিভাগপূর্ব অনেক লেখকের লেখায় অনবরত পাই৷ পূর্ব বাংলার ভাষার ব্যাপারটি মোটেই সাতচল্লিশ-পরবর্তী আবিষ্কার নয়৷

Mohammad Azam Schriftsteller
মোহাম্মদ আজম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ছবি: Privat

তিন. একটা খুব বাজে ধারণা এখানে অনেকের মধ্যে চালু আছে যে, ভাষা একবার বিধিবদ্ধ হলে তার পবিত্রতা রক্ষা করতে হয়৷ এই চিন্তা থেকে ভাষাকে ধরে-বেঁধে রাখার একটা অভিলাষ দেখি অনেকের মধ্যে৷ ভাষা সম্পর্কে যার প্রাথমিক জ্ঞান আছে, সে-ই বুঝবে, এটা মোটেই ‘ভাষাসম্মত' নয়৷

ঢাকার ‘প্রমিত' বা ‘মান' বাংলার আলোচনায় এই তিন সমস্যার কথা মনে রাখলে আলাপে গতি আসবে, বিরোধ-স্ববিরোধ কমবে, আর ভাষা কাজ-চালানোর মতো করে বিধিবদ্ধ করার কাজটাও দ্রুতগতিতে এগোবে৷

বাংলা ভাষার সবচেয়ে বড় সংকটের জায়গা হলো, আবেগে ভর করেই আমরা বাংলার প্রতি দায়িত্ব শেষ করছি৷ বাংলার পক্ষে যুক্তি তৈরি করিনি৷ ফলে একটা আস্ত ‘রাষ্ট্রভাষা' আন্দোলন সবার চোখের সামনে ‘মাতৃভাষা আন্দোলন' হয়ে উঠল– কেউ বিশেষ উচ্চবাচ্য করল না৷ কারণ, মাতৃভাষা কথাটার সাথে আবেগের যোগ বেশি৷ আমাদের ইংরেজি-মাধ্যম পড়াশোনা আর মাতৃভাষার প্রতি আবেগ সমানতালে চলতে পারে৷ কোনো বিরোধ তৈরি হয় না৷ এটা এদেশের সুবিধাভোগী উচ্চশ্রেণির সজ্ঞান বা অজ্ঞান চালাকি৷ এতে বিদ্যমান কাঠামো ঠিক থাকে; দেশপ্রেম, ভাষাপ্রেম আর শ্রেণিস্বার্থ একসাথে রক্ষিত হয়৷

বাংলাদেশে যাঁরা গত চার দশক ধরে বাংলাভাষার শুদ্ধতা রক্ষা ও আরো নানা নামে ভাষাপ্রেম দেখিয়ে আসছেন, তাঁদের আন্তরিকতায় সন্দেহ করার ঘোরতর কারণ আছে৷ দেখাই যাচ্ছে, এরা এই দেশের প্রভাবশালী অংশ৷ চাইলে বাংলার সর্বজনীন ব্যবহার নিশ্চিত করার কার্যকর উদ্যোগ নেয়া এদের পক্ষে সম্ভব৷ কিন্তু অফিস-আদালত, শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষায় বাংলা চালুর কার্যকর উদ্যোগ-আয়োজন তো দেখা যাচ্ছে না৷ সন্দেহ করার কারণ আছে, এইসব কাজের উদ্যোগ না নেয়ার যে অপরাধ, তা আড়াল করার জন্যই ‘ভাষার শুদ্ধতা' রক্ষার উপর বাড়তি ‘কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভাষাতত্ত্ব-অসম্মত' জোর দেয়া হচ্ছে৷ আসল কাজ কিছু কিছু হলে এই নকল কাজের উপর এত চাপ পড়ত না৷

ভাষাকে গণতান্ত্রিকতার পথে এগিয়ে যাওয়ার, অর্থাৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের প্রধান অস্ত্র করে তোলা যায়৷ এর প্রথম দিক জনশিক্ষা৷ পরের ধাপ বাংলার সর্বাঙ্গীণ ব্যবহার, যাতে বিভাষায় হোঁচট খেয়ে বিপুল মানুষ রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে না করে৷ এগুলো রাজনৈতিক কাজ, ‘প্রেমমূলক' ব্যাপার নয়৷ ‘প্রমিত' ভাষার মামলাও এই কাজের আরেক মুখ বৈ নয়৷ আমাদের দরকার এমন প্রমিত, যাতে সম্ভাব্য সবচেয়ে বেশি মানুষের অংশগ্রহণ থাকবে৷ তথাকথিত আঞ্চলিক ভাষাভাষী মানুষেরা ভদ্রলোকি ভাষার মধ্যে নিজেদের অংশ আবিষ্কার করে আশ্বস্ত হবে৷ নিজেকে এর অংশ মনে করবে৷ আর ভাষার প্রমিতকরণ হবে এক ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, একবার হয়ে যাওয়ার পর কেতাব-কোরানের মতো শুদ্ধতা রক্ষার উপাদান নয়৷ ভাষার শুদ্ধরূপ নয়, দরকার দশের অংশগ্রহণে তৈরি হওয়া দশের মেনে নেয়া রূপ৷ দরকার গণতান্ত্রিকতা৷

যুক্তির জায়গায় আবেগ, উপযোগিতার জায়গায় ঐতিহ্য, সর্বাঙ্গীন ব্যবহারের তুলনায় সাহিত্যিক এলিট রূপের প্রাধান্য– এই তিনটি বাংলার প্রধান শত্রু৷ এই তিন শত্রুমুক্ত ভাষাপরিস্থিতি নিশ্চিত করতে পারলেই বাংলাদেশে বাংলা ভাষার যথার্থ প্রগতি সম্ভবপর হবে৷

বাংলা ভাষার যথার্থ প্রগতি সম্ভব হচ্ছে? লিখুন নীচের ঘরে৷ 

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য