নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে, ঠেকানোর পদক্ষেপ অপর্যাপ্ত – DW – 21.09.2024
  1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে, ঠেকানোর পদক্ষেপ অপর্যাপ্ত

সমীর কুমার দে ঢাকা
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়লেও খুব একটা ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ঘটনা আলোচনা সৃষ্টি করেছে।

https://p.dw.com/p/4kvlj
নারীর ওপর সহিংসতার প্রতিবাদে ঢাকায় বিক্ষোভ
রাজধানী ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সম্প্রতি নারীর ওপর হামলা, অবমাননা এমনকি অপহরণ ও ধর্ষণের ঘটনাও ঘটেছেছবি: Sazzad Hossain/DW

কুড়িগ্রামে এক ছাত্রীকে অপহরণের পর ধর্মান্তরিত করা হয়েছে। খোদ ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ষাটোর্ধ্ব নারী গণধর্ণণের শিকার হয়েছেন। এমনকি পর্যটন এলাকা কক্সবাজারের সৈকতে হেনস্থার শিকার হয়েছেন নারীরা। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ জানিয়েছে, ৫ আগস্ট থেকে ২০ আগস্টের মধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ৪ জন নারী গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এসব ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন নারী নেত্রীরা।

নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনায় কি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে সমাজকল্যাণ এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এসব ঘটনায় বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে কিছু উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। আমরা তো এসব ঘটনা জেনে বসে থাকতে পারি না। আপনি নিশ্চয় দেখবেন খুব শিগগিরই আমরা কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছি।”

এলাকায় পোস্টার লাগানোর পর কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীতে দশম শ্রেণির এক ছাত্রীকে অপহরণ করা হয়েছে। গত বুধবার বিকেলে ফুলবাড়ী উপজেলার কাশিপুর ইউনিয়নে ওই স্কুলছাত্রী প্রাইভেট পড়ে ফেরার পথে তাকে অপহরণ করা হয়। ওই ছাত্রীর বাবা ফুলবাড়ী থানায় অভিযোগ করেছেন। ওই গ্রামে ৩০টি হিন্দু পরিবার বসবাস করে। গত ২ সেপ্টেম্বর রাতে গ্রামের হিন্দু পাড়ায় কয়েকটি গাছে পোস্টার সেঁটে দেয় দুর্বৃত্তরা। সেখানে লেখা হয়, ৭ দিনের মধ্যে অপহরণ করা হবে এবং হিন্দু থেকে মুসলিম করা হবে। এ ঘটনায় ফুলবাড়ী থানায় একটি সাধারণ ডায়রিও (জিডি) করা হয়েছিল। তারপরও অপহরণের ঘটনায় উদ্বিগ্ন এলাকার মানুষ।

এত ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, কিন্তু আমরা কোন ব্যবস্থা নিতে দেখছি না: ডা. ফওজিয়া মোসলেম

ফুলবাড়ী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নওয়াবুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, "ঘটনার ১২ ঘন্টার মধ্যে আমরা ওই ছাত্রীকে উদ্ধার করেছি। ছেলেটিকেও ধরা হয়েছে। তারা আদালতে জানিয়েছে, প্রেমের সম্পর্কের কারণে তারা পালিয়ে গিয়েছিল। মেয়েটি স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে বলে আদালতে স্বীকার করেছে।”

ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ষাটোর্ধ্ব এক নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়েছে। এতে অসুস্থ হয়ে পড়েন ওই বৃদ্ধা। গত সোমবার সকালে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করা হয়েছে। ওই নারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তার বাড়ি নারায়নগঞ্জের ফতুল্লায়। পরিচিত এক নারীর সঙ্গে ত্রাণের আশায় গত শুক্রবার তিনি ঢাকায় আসেন। সেই নারী তাকে চারুকলার ছবিরহাটের ওইদিকে রেখে কোথাও চলে যান। শনিবার রাতে ভিক্ষাবৃত্তির জন্য তিনি উদ্যানে ঘুরছিলেন। এরই মধ্যে সন্ধ্যা হয়ে এলে মধ্যবয়সী কয়েকজন লোকের খপ্পরে পড়েন তিনি। তারপর শনিবার রাতে কয়েকটি জায়গায় নিয়ে ওই ব্যক্তিরা কয়েক দফা তাকে ধর্ষণ করেছে। এরপর তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। জ্ঞান ফেরার তিনি এসব তথ্য জানিয়েছেন। এই ঘটনায় পুলিশ এখনও কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।

নারী নেত্রী খুশি কবীর ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এই ঘটনাগুলো তো উদ্বেগের। আমরা আশা করব সরকার এসব ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেবে। তা না হলে সাধারণ মানুষের আকাঙ্খা পূরণ হবে না। দৃশ্যমান কিছু পদক্ষেপের মাধ্যমে সরকারকে দেখাতে হবে তারা কিছু করছে। তাহলে এই ধরনের অপরাধ কমে আসবে বলে আমার বিশ্বাস।”

কক্সবাজারে সমুদ্র সৈকতে নারীদের হয়রানির ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় তা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এই হয়রানির সূত্রপাত লাঠি হাতে থাকা যে যুবকের মাধ্যমে তাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কক্সবাজার সদর থানায় মামলা দায়েরের পর তাকে আদালতে পাঠানো হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। গত শুক্রবার নারীদের হেনস্থা করার এমন তিনটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এসব ঘটনাকে মানবাধিকার লঙ্ঘন বলে বর্ণনা করেছেন মানবাধিকার কর্মীরা।

ভাইরাল এক ভিডিওতে দেখা যায়, একদল উৎসাহী জনতা এক নারীকে কান ধরিয়ে ওঠ-বসা করাচ্ছে। আর তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন কাঠের তক্তা হাতে এক যুবক। ভিডিওর শুরুতে দেখা যায়, ওই যুবক এক নারীর মুখের সামনে কাঠের তক্তা তুলে নানা ধরনের প্রশ্ন করছেন। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরেক নারী মেয়েটির মুখ থেকে জোর করে মাস্ক টেনে খুলে ফেলেন। এক পর্যায়ে লাঠির আঘাত থেকে রক্ষা পেতে ভুক্তভোগী ওই নারী কান ধরে ওঠবস করতে বাধ্য হন।

এই ঘটনাগুলো সমাজে কি বার্তা দিচ্ছে? জানতে চাইলে বাংলাদেশ মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এগুলো তো শুধু নারী নির্যাতন নয়, মানবাধিকার লংঘনও। যদিও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, কেউ আই নিজের হাতে তুলে নেবেন না। শুধু এই কথা দিয়ে হবে না। কার্যকর কিছু পদক্ষেপও নিতে হবে। আমরা সরকারের উপর আস্থা রাখতে চাই যে তারা কার্যকর ব্যবস্থা নেবে।”

আপনি নিশ্চয় দেখবেন খুব শিগগিরই আমরা কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছি: শারমীন এস মুরশিদ

দেশের বিভিন্ন জেলায় নারীর প্রতি সহিংসতা ও হত্যার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। গত ১৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় সংবাদ মাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ উদ্বেগ প্রকাশ করেন পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম ও সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু। বিবৃতিতে বলা হয়, সাতক্ষীরা জেলার সদর উপজেলার লাবসা ইউনিয়নের থানাঘাটা এলাকায় উচ্চ শব্দে বাজানোয় বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী তরুণীকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনা ঘটেছে। ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জ পৌর এলাকার ওয়াগাঁও মহল্লার এক নারীকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে মামলা করায় ওই নারীকে মধ্যযুগীয় কায়দায় শারীরিক নির্যাতন ও হত্যার চেষ্টার ঘটনা ঘটেছে। কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর যমুনা সদরের যমুনা ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নির্যাতনের শিকার নারী তার স্বামীর অপারেশনের জন্য যেখানে যান। গত ১৪ সেপ্টেম্বর শনিবার ব্যান্ডেজ করে দেওয়ার কথা বলে রোগীর স্ত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে এবং নির্যাতনের পাশাপাশি নির্মম ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে।

মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এত ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, কিন্তু আমরা কোন ব্যবস্থা নিতে দেখছি না। এটা অবশ্যই উদ্বেগের। অনেক ঘটনাই মিডিয়ায় আসছে না। নারীকে রাতে তুলে নিয়ে সকালে ফেরত দেওয়া হচ্ছে। ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে। বিশ্বাস করা যায়, ষাটোর্ধ্ব এক নারী ত্রানের আশায় ঢাকায় এসেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় তাকে গণধর্ষণ করা হচ্ছে। আগে তো পুলিশ কিছু ব্যবস্থা নিতো। এখন পুলিশও একটিভ না। ফলে আমরা বিচারের জন্য কোথায় যাবো? ইতিমধ্যে আমরা মানববন্ধন করেছি, মনে হচ্ছে আমাদের প্রতিদিনই মানববন্ধন করতে হবে। এসব ঘটনায় আমরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ।”

এদিকে বিভিন্ন এলাকায় ভাসমান যৌনকর্মীরা মারধরের শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। রাজধানীর রাস্তায় যৌনকর্মীদের মারধরের কিছু ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরালও হয়েছে। এ সব ঘটনায় অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার ও শাস্তি দাবি করেছেন মানবাধিকারকর্মীরা। ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওর শুরুতেই প্রহারকারী যুবককে বলতে শোনা যায়, "এইভাবে উচ্ছেদ করতে হবে পতিতাদের। এক গ্রুপকে মারছি, আরেক গ্রুপ আসছে।” এরপর ওই যুবক সবুজ রঙের পাইপ দিয়ে এক নারীকে বেধড়ক পেটাতে থাকেন। এরপর আরেকজনকে তাড়া করেন। পরে এক কিশোরীকে পেটাতে থাকেন। যুবকের পা ধরে মেয়েটি বারবার বলতে থাকে, "এ কাজ ছাইড়া দিমু।”

মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ বলেন, "যৌনকর্মীদের ওপর হামলা মানবাধিকার লঙ্ঘন। আমরা ইমিডিয়েটলি পুলিশকে জানিয়েছি যেন এটা বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এটা আমাদের নজরে এসেছে। আমরা এটাকে সিরিয়াসলি দেখব। এটা যেন আর না ঘটে সে ব্যবস্থা করতে হবে।”