ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির উর্বর ভূমি – DW – 30.10.2020
  1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির উর্বর ভূমি

গোলাম মোর্তোজা
৩০ অক্টোবর ২০২০

যুদ্ধ করে একটি স্বাধীন দেশ অর্জন করলেও, সামাজিক-সাংস্কৃতিক রুচিবোধে উত্তরণ ঘটাতে পারিনি৷ আমাদের সমাজ জীবনে ধর্মের প্রভাব খুব বড়ভাবেই ছিল৷

https://p.dw.com/p/3kdce
ছবি: Suvra Kanti Das/Zumapress/picture alliance

মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি তার প্রমাণ৷ যুক্তি দেওয়া যেতেই পারে যে, বাঙালি মননে ধর্ম অতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না বলেই মুসলিম লীগ বিলীন হয়ে গেছে৷ জামায়াতের রাজনীতির গুরুত্ব ও প্রভাব কমে গেছে৷ সাদা চোখে এ যুক্তি বেশ গ্রহণযোগ্য মনে হতে পারে৷ কিন্তু একটু চিন্তা দিয়ে পর্যবেক্ষণ বা সমাজ বিশ্লেষণ করলে ভিন্ন বাস্তবতা দৃশ্যমান হতে পারে৷ ‘হতে পারে’ বলছি একারণে যে,নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গিতে বিষয়টি আসলে কখনও বিশ্লেষণই করা হয়নি৷ অগ্রসর শিক্ষিত শ্রেণী, যারা শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী-সমাজ চিন্তক লেখক তাদের থেকে সমাজ বিশ্লেষণ প্রত্যাশিত ছিল৷ তাদের থেকে বিশ্লেষণটা কখনও আসেনি৷ এর একটি কারণ হয়ত এই যে,যাদের থেকে এই বিশ্লেষণ আসতে পারত-তাদের আমরা ১৯৭১ সালে হারিয়েছে৷ পাকিস্তানিরা দেশীয় জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের সহায়তায় তালিকা করে তাদের হত্যা করেছে৷ এও খুব তাৎপর্যপূর্ণ যে, শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী-সমাজ চিন্তক মানুষগুলোকে হত্যা করা হয়েছে স্বাধীনতার ঠিক আগে দিয়ে৷ যখন পাকিস্তানিরা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে,তখনই তাদের হত্যা করা হয়৷ বাংলাদেশ যাতে জ্ঞানভিত্তিক অগ্রসর চিন্তার দেশে পরিণত হতে না পারে, লক্ষ্য ছিল সেটাই৷ কোনো সন্দেহ নেই যে, তাদের লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে৷ বাঙালি জাতি যুদ্ধ করে পাকিস্তানিদের পরাজিত করেছে৷ পরাজিত পাকিস্তানিরা বাঙালি জাতির শীর্ষ জ্ঞানের দিশারিদের হত্যা করে চিন্তাজগতকে অন্ধকার করে দিয়ে গেছে৷ সেই অন্ধকারকে আলোকিত করা যাদের দায়িত্ব ছিল, তারা সেই অন্ধকার দূর করতে পারেনি৷ শিক্ষক-চিন্তক শুন্য স্থানে যারা দৃশ্যমান হয়েছেন, তাদের অধিকাংশের চিন্তাজগত বিস্তৃত ও দিকনির্দেশনা সমৃদ্ধ ছিল না৷ ছিল না তাদের চিন্তার গভীরতা৷ তাদের চিন্তাজগতের সংকীর্ণতার মূল্য স্বাধীন বাংলাদেশকে দিতে হয়েছে৷

মুক্তিযুদ্ধের পরের স্বাধীন বাংলাদেশে দাড়ি-টুপিকে রাজাকার-আল বদর-আল শামসের সিম্বল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে৷ গল্প-উপন্যাস,নাটক-সিনেমা সর্বত্র ব্যবহার করা হয়েছে৷ একথা সত্যি যে,জামায়াতে ইসলামী ইসলাম ধর্মের নাম ব্যবহার করেই একাত্তরে যুদ্ধাপরাধ করেছিল৷ জামায়াতের নেতা গোলাম আযম, নিজামীরা দাড়ি-টুপিধারী ছিল৷ রাজাকারদেরও অনেকের দাড়ি-টুপি ছিল৷ দাড়ি-টুপি ছাড়া রাজাকারও ছিল৷

দেশের মোট জনসংখ্যার তুলনায় জামায়াত-রাজাকারের সংখ্যা ছিল অতি নগন্য৷ জামায়াত-রাজাকারদের তুলনায় অনেক বেশি সংখ্যক দাড়ি-টুপি পরিহিত বা ধর্ম পালন করা মানুষ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন৷ অধিকাংশ তরুণ মুক্তিযোদ্ধার বাবা-চাচা-দাদা ছিলেন দাড়ি-টুপি পরিহিত ধর্ম পালনকারী৷ স্বাধীন দেশে রাজাকার ‘ঘৃণা’ শব্দে পরিণত হবে,সেটাই স্বাভাবিক৷ কিন্তু দাড়ি-টুপিকে ঘৃণ্য রাজাকারের সিম্বলে পরিণত করাটা ছিল চূড়ান্ত রকমের অদূরদর্শী কর্ম৷যা বাংলাদেশের নাটক সিনেমায় বছরের ধরে করা হয়েছে৷ এই জায়াগাটিতে কোনো দুরদর্শী দিকনির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হয়েছে বুদ্ধিজীবী চিন্তক শ্রেণী৷ তারাও এই স্রোতে গা ভাসিয়েছেন৷ তারা একদিকে প্রগতিশীলতার কথা বলে ইসলাম ধর্ম পালন বিষয়ে উন্নাসিকতা দেখিয়েছেন৷ আবার সংস্কৃতির কথা বলে অন্য ধর্ম পালনের অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছেন৷ তাদের এই স্ববিরোধী আচরণ দেশের মানুষ দেখেছেন৷ ফলে জনমানুষ থেকে তারা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন৷ তারা কথা-লেখা-কাজ দিয়ে মানুষকে প্রভাবিত করতে পারেনি৷

এরই পরিণতিতে ধর্মাশ্রয়ে রাজনীতির উর্বর ভূমি পেয়েছে সামরিক শাসকেরা৷ জিয়াউর রহমান ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সুযোগ করে দিয়েছে৷ জামায়াতে ইসলামীকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছে বিএনপি৷ ধর্মের ব্যবহারে রাজনীতিও করেছে৷

এরশাদ আরেক ধাপ এগিয়ে ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম করেছে৷ খালেদা জিয়া জামানায় জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছে৷
এই ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মুক্তচিন্তার প্রগতিশীল সমাজ-নির্মাণের রাজনীতি করেছে বামধারা ও আওয়ামী লীগ৷ বামধারা বইয়ের ভাষায় কথা বলে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে গেছে৷ বাম নেতাদের অনেকে ক্ষমতার মোহে আওয়ামী লীগে আশ্রয় খুঁজেছে৷ জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে রাজনীতি করেছে আওয়ামী লীগ৷ যুদ্ধাপরাধের বিচারের মত প্রায় অবিশ্বাস্য কর্মটিও সম্পন্ন করেছে আওয়ামী লীগ সরকার৷

Bangladesh Journalist Golam Mortoza
গোলাম মোর্তোজা, সাংবাদিকছবি: Golam Mortoza

আবার বিষ্ময়কর হলেও সত্যি, আওয়ামী লীগ ক্রমান্বয়ে তার নিজের নীতি পরিত্যাগ করে সামরিক শাসকদের নীতির দিকে ঝুঁকে পড়েছে৷ হিজাব পড়েছে, জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন করেছে, মদিনা সনদ অনুযায়ী দেশ চালানোর বক্তৃতা করেছে৷ হেফজতের সঙ্গে আপোষ করেছে৷পাঠপুস্তক সাম্প্রদায়িকরণ করেছে৷ এখন সরকারের জনস্বাস্থ্য ইনসটিটিউট হিজাব ও টাকনুর উপর কাপড় পরিধানের নির্দেশ জারি করছে৷ শোকজ হচ্ছে,নির্দেশ প্রত্যাহারও হচ্ছে৷ কিন্তু নির্দেশ জারির যে মনোজগত, তা তো থেকেই যাচ্ছে৷ এই মনোজগতই নাটক-সিনেমায় কবুল বলা যাবে না,আইন করতে চাইছে৷

বলা হয়ে থাকে আওয়ামী লীগ বাধ্য হয়ে নীতি থেকে সরে এসেছে৷এই যুক্তি সঠিক হলে আওয়ামী লীগের সমর্থন বা ভোট বাড়ার কথা৷ কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি৷ আওয়ামী লীগের যে কমবেশি ৩৮ শতাংশ ভোট, তা বাড়েনি৷

ভোটারবিহীন ও রাতের নির্বাচন বিবেচনায় নিয়ে হিসেব করছি না৷ নীতি ত্যাগের ফলশ্রুতিতে ভোট না বাড়লেও বা কমলেও, ক্ষমতায় থাকতে পারছে৷ বাহিনী-প্রশাসন ব্যবহার করে ক্ষমতায় যাওয়া-থাকা সামরিক শাসকদের নীতি৷ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতিও সামরিক শাসকদের নীতি৷ সামরিক শাসকদের গড়া দলের মত, আওয়ামী লীগও তা করছে৷ ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতিতে কে কতটা এগিয়ে সেই প্রতিযোগিতার দৌঁড়ে অংশগ্রহণকারী সবাই, বামধারা বাদে৷ ফলে ক্রমান্বয়ে মুক্তচিন্তা-মুক্তবুদ্ধি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে৷ রাজনৈতিক বক্তৃতায় দেশে এগিয়ে গেলেও, অগ্রসরমান চিন্তাধারায় ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে৷

২০১৬ সালের ছবিঘরটি দেখুন...