‘‌জ্ঞানপীঠ'‌ পেলেন শঙ্খ ঘোষ – DW – 26.12.2016
  1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘‌জ্ঞানপীঠ'‌ পেলেন শঙ্খ ঘোষ

শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা
২৬ ডিসেম্বর ২০১৬

শেষ জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পেয়েছিলেন মহাশ্বেতা দেবী৷ ২০ বছর পর আবার এক বাঙালি চিন্তাবিদের হাতে উঠতে চলেছে এই সম্মান৷

https://p.dw.com/p/2Us5m
ফাইল ছবিছবি: DW/ S.Bandopadhyay

কবি, প্রাবন্ধিক, চিন্তাবিদ শঙ্খ ঘোষ মানুষ হিসেবে চিরকালই অন্তর্মুখী, নিভৃতচারী৷ অন্তর্মুখী, কিন্তু মানবিক সংকটের সময় তিনি সততই সবাক৷ বাঙালির অতন্দ্র বিবেকের মতো তিনি জেগে বসে থাকেন বিপন্ন মানুষের শয্যাপাশে৷ যে ঘোর দুঃসময়ে বাংলার কবি, সাহিত্যিক, চিন্তাবিদরা আপোসে অথবা আতঙ্কে স্তব্ধবাক, মুখ লুকিয়ে ফেলেন সরকারি দাক্ষিণ্য, পদমর্যাদা অথবা পুরস্কারের আড়ালে, তখন তাঁর অনুচ্চকিত শঙ্খধ্বনিতেই কেবল প্রতিবাদের বজ্রনির্ঘোষ৷ পশ্চিমবঙ্গে যখন সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের মতো অন্যায় ঘটেছিল, সবাইকে অবাক করে প্রতিবাদ মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন তিনি, শঙ্খ ঘোষ৷ তখনও বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এবং সেই সরকারের অনুগ্রহভোজী বহু দুর্বুদ্ধিজীবী তখনও বাম অপশাসনের পক্ষে নির্লজ্জভাবে কথা বলে যাচ্ছেন৷ কিন্তু শঙ্খ ঘোষ প্রতিবাদী কণ্ঠেই জোর জুগিয়েছেন সেসময়৷ তাঁর মিছিলে হাঁটা সেসময় স্পষ্ট সংকেত পাঠিয়েছিল বাম শাসকদের, যে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, নেতাই, এগুলো ভুল, অন্যায়৷ যদিও সেই প্রথম নয়, তার কত আগে থেকেই শঙ্খ ঘোষ চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছিলেন পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থিদের বিচ্যুতি৷ কে ভুলতে পেরেছে ‘‌ন্যায় অন্যায় জানিনে'‌ কবিতায় তাঁর সেই অমোঘ উচ্চারণ—

‘‌‘‌তিন রাউন্ড গুলি খেয়ে তেইশজন মরে যায়, লোকে এত বজ্জাত হয়েছে

স্কুলের যে ছেলেগুলো চৌকাঠেই ধসে গেল, অবশ্যই তারা ছিল

সমাজবিরোধী৷

ওদিকে তাকিয়ে দেখো ধোয়া তুলসীপাতা

উল্টেও পারে না খেতে ভাজা মাছটি আহা অসহায়

আত্মরক্ষা ছাড়া আর কিছুই জানে না বুলেটরা

দার্শনিক চোখ শুধু আকাশের তারা বটে দেখে মাঝে মাঝে‌

পুলিস কখনো অন্যায় করে না যতক্ষণ তারা আমার পুলিস!‌'‌'‌

২০১১ সাল থেকে পরিবর্তনের জমানা৷ অতীতে যে দুর্বুদ্ধিজীবীরা বামশাসকদের স্বনিযুক্ত উকিল ছিলেন, তাঁরাই তখন প্রাণপণে, মুখে রক্ত তুলে এবং কলমের কালি উছলে লিখে চলেছেন, শুধু বামপন্থিরাই নয়, আদত বামপন্থাই কত খারাপ, নিকৃষ্ট একটি মতবাদ৷ তুলনায় অনেক উচ্চতর, মহত্তর এক রাজনৈতিক-প্রশাসনিক বিকল্পের জয়গানে মুখরিত হয়েছেন সবাই৷ পারিতোষিক হিসেবে তাঁরা পদ পাচ্ছেন, এবং পুরস্কার৷ পাশাপাশি পোঁ ধরেছে তোষামুদে সাংবাদিক এবং সংবাদমাধ্যম৷ প্রত্যক্ষ চেষ্টা চলছে সমালোচনার কণ্ঠরোধের, বিরোধী হলেই তাকে ষড়যন্ত্রী শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করার৷ সেই তাঁবেদার-লাঞ্ছিত সময়ে শঙ্খ ঘোষ ১৯৩৩ সালে জার্মানিতে হিটলারের প্রচারমুখ, মিথ্যাশিরোমনি গ্যোবেলসকে ফিরিয়ে আনলেন তাঁর কবিতায়৷ নির্মম কৌতুকে লিখলেন –

‘‌‘‌.‌.‌.‌এই নবসৃষ্টিকালে সত্য নয়, ন্যায় নয় একমাত্র লক্ষ্য হলো জয়

একমাত্র লক্ষ্য হলো জনমনে অবশতা আনা

এবং বশ্যতা

একমাত্র লক্ষ্য হলো অলীক আশ্বাস এবং আশা

পরিসংখ্যানের ভারে যে কোনও মোহন প্রতিশ্রুতি

যে কোনও আহুতি

উঁচু থেকে আরও আরও উঁচু কোনও খরতর স্বরে

কেবলই জাগাতে হবে ভয়

সহজে বোঝাতে হবে, প্রতিবাদীমাত্রে শুধু ষড়যন্ত্রী, আর

প্রতিরোধকারীমাত্রে আক্রমণকারী—

হাত-পা হবে হিম

নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে সংবাদমাধ্যম সব, শিল্পের মাধ্যম যতকিছু

প্রেস বা রেডিয়ো কিংবা ফিলম্‌৷''

শঙ্খ ঘোষ জ্ঞানপীঠ সম্মানে ভূষিত হওয়ার ঘোষণা শুনে অনুজ কবি-সাংবাদিক মৃদুল দাশগুপ্ত তাই খুব সঙ্গত কারণেই বললেন, যে কোনও কবি-সাহিত্যিককে জ্ঞানপীঠ পুরস্কার দেওয়া হয় না৷ পুরস্কৃত করা হয় তাঁদেরকেই, যাঁরা সময় এবং সমাজের বিবেক হয়ে উঠতে পেরেছেন৷ জ্ঞানপীঠ প্রাপকদের তালিকাও সেই কথাই বলে৷

১৯৬৬ সালে কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম বাঙালি, যিনি জ্ঞানপীঠ পান৷ তার পর ১৯৭১ সালে কবি বিষ্ণু দে, ১৯৭৬ সালে সাহিত্যিক আশাপূর্ণা দেবী, ১৯৯১ সালে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় এবং ১৯৯৬ সালে এসে মহাশ্বেতা দেবী৷ ভারতে সাহিত্যের সর্বোচ্চ বেসরকারি পুরস্কার দু'টি৷ একটি এই জ্ঞানপীঠ এবং অন্যটি সরস্বতী পুরস্কার৷ সাধারণভাবে একটা অলিখিত নিয়ম আছে যে যিনি জ্ঞানপীঠ পান, তিনি সরস্বতী পুরস্কার পান না৷ এবং উল্টোটা৷ তরুণ কবি সন্দীপন চক্রবর্তী খেয়াল করিয়ে দিলেন যে শঙ্খ ঘোষই প্রথম এবং একমাত্র, যিনি দু'টি পুরস্কারই পেলেন৷

তবে এই নিয়েও একটি বিতর্ক শুরু হয়েছে৷ শঙ্খ ঘোষ সরস্বতী পুরস্কার নিতে যাননি, কারণ তা নিতে হতো হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারের প্রতিনিধি, প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ীর থেকে৷ এবার জ্ঞানপীঠ পুরস্কারও কিন্তু তাঁকে নিতে হবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর হাত থেকে৷ তিনি কি নেবেন?‌ প্রশ্নটা উঠছে, কারণ আপোসহীন, শিরদাঁড়া টান, মাথা উঁচু মানুষটির নাম শঙ্খ ঘোষ৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য