কঠিন সময়ে ততোধিক কঠিন সাংবাদিকতা – DW – 21.09.2024
  1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

কঠিন সময়ে ততোধিক কঠিন সাংবাদিকতা

গৌতম হোড়
গৌতম হোড়
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

একটা অসহিষ্ণু, যুক্তিহীন সময়ে ক্ষমতাধররা সমানে চাপ দিচ্ছে সংবাদমাধ্যমের উপর, নিজেদের স্বার্থপূরণের জন্য।

https://p.dw.com/p/4kvWA
ভারতের জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সাংবাদিকদের প্রতিবাদ
ভারতের সংবাদমাধ্যমকে কেবল রাজনৈতিক চাপ নয়, বিজ্ঞাপন, সমাজ ও জনগণের চাপও সামলাতে হয়ছবি: Newslaundry

 ক্যাব-চালকের কথাটা শুনে ভয়ঙ্কর অবাক লাগলো। 

তখন সবে আরজি করে চিকিৎসকের ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা সামনে এসেছে। বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। সিভিক ভলান্টিয়ারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, তারা নিজে থেকে মামলা শুরু করছে। শুনানির তারিখও দিয়ে দিয়েছে তারা। 

ক্যাব-চালক বললেন, সুপ্রিম কোর্ট তো ওইদিন অভিযুক্তের ফাঁসির নির্দেশ দিয়ে দেবে। যে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তিনি কথাটা বললেন, তাতে মনে হলো, তিনি নিশ্চয়ই কথাটা কারো কাছ থেকে শুনেছেন। জানতে চাইলাম, তিনি কী করে এটা ভাবলেন? তদন্তই হলো না, বিচার হলো না, প্রথম দিনের শুনানিতে ফাঁসির নির্দেশ কী করে দেবে কোনো আদালত? 

তিনি জানালেন, ইউটিউবে খবরের চ্যানেলে ওই ঘটনা নিয়ে যে রিপোর্টিং, আলোচনা, মতামত শুনেছেন, তা থেকেই তার এই ধারণা হয়েছে। সাংবাদিকতা এখন কেমন চলছে, তা নিয়ে লিখতে গিয়ে এর থেকে ভালো উদাহরণ আর হয় না। 

আগে সাংবাদিকতা মানে ছিল শুধু খবরের কাগজ। তারপর তার সঙ্গে যুক্ত হলো টিভি। এখন সেই দিগন্ত প্রসারিত হয়ে তার মধ্যে ঢুকে গেছে ডিজিটাল মিডিয়া। ইউটিউবের মাধ্যমে রবিশ কুমার, আশুতোষ-সহ হাজার হাজার সাংবাদিক পৌঁছে যাচ্ছেন বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছে। আর আছেন অসংখ্য ইউটিউবার। তারাও ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। টিভি চ্যানেল থেকে ইউটিউবে সাংবাদিক ও অপ্রশিক্ষিত সাংবাদিকরা সমানে তাৎক্ষণিক বিচার করে ফেলছেন। তাদের কাছে তদন্তের দরকার নেই, বিচার প্রক্রিয়ার দরকার নেই। সুপ্রিম কোর্ট যে নিজে থেকে ফাঁসির নির্দেশ দেয় না, নিম্ন আদালতের ফাঁসির নির্দেশ বহাল রাখে বা খারিজ করে দেয়, সেটা জানার দরকার নেই, তারা বিচারটা করে দিচ্ছে। কোনো ঘটনা ঘটার পরমুহূর্তেই রায় দিয়ে দেয়া হচ্ছে, কে দোযী। 

বদলে যাওয়া সময়ে, বদলে যাওয়া আবহে সাংবাদিকতাও বদলে গেছে। এই অসহিষ্ণু সাংবাদিকতাকে কে রোধ করবে? কে বালির বাঁধ দেবে? 

বর্তমান সময়ের সাংবাদিকতায় চারপাশে ভয়ঙ্কর চাপের ছবি ছড়িয়ে আছে। সরকারি চাপ, ক্ষমতাসীন দলের চাপ, বিজ্ঞাপন বন্ধের চাপ, কত রকমের চাপ আছে। অনেকগুলি বড় সংবাদমাধ্যম গোষ্ঠীর মালিক হলো কর্পোরেট সংস্থা। ফলে তাদের উপর আলাদা চাপ থাকে। এ সবের প্রতিফলন খবরের মধ্যে সাংবাদিকদের কাজের উপর পড়ে। কীভাবে পড়ে? খবরের কাগজের উদাহরণ দেয়া যাক। একটা খবর যদি খুব গুরুত্বপূর্ণ হয় তাহলে প্রথম পাতায় যায়। দেশের গুরুত্বপূর্ণ খবর ভিতরে দেশের জন্য চিহ্নিত জায়গায় বড় করে যায়। চাপ আছে এমন খবর সেক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বহীনভাবে ছোট করে দেয়া হয়। খবরের কাগজের ভাষায় ধরিয়ে রাখা হলো। কখনো বা সেই খবর একদিন পরে যায়, কখনো যায়ই না। 

তাহলে সেই সংস্থার সাংবাদিক কী করবে? সে বুঝে যায় বা বুঝিয়ে দেয়া হয়, কোন খবরের গুরুত্ব বেশি হবে, কোন খবরের গুরুত্ব কম হবে। তাকেও চাকরি করতে গেলে সেইভাবে চলতে হয়। অথবা এরপরেও সে গুরুত্ব দিয়ে খবর করে, তারপর তা গুরুত্বহীন হয়ে ছোট করে যায়। 

টিভি-র অবস্থাটা তো আরো ভয়ঙ্কর। সেখানে যাকে গুরুত্ব দেয়া হবে না, তার একটা বাইট দেয়া হলো। তারপরই তার বিপক্ষ নেতাদের বক্তব্য ও সমালোচনাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখানো হতে থাকলো। সংবাদ পরিবেশকও তাদের সুরে মন্তব্য করতে শুরু করলো। ফলে দর্শকের কাছে কোন খবরটা গেল? কীভাবে গেল? এটাই গেলো যে ওই নেতা বালকোচিত আচরণ করেছে, বা খুবই খারাপ, যুক্তিহীন কথা বলেছেন। এই চাপের মুখে সাংবাদিক কী করবে? সে তখন সহজ পথটা নেয়, নিজের চাকরি বাঁচায়। 

আমরা যখন সাংবাদিকতা শুরু করি, তখন প্রথমেই শেখানো হয়েছিল, সরকারের কাছে প্রচারের অনেক সাধন আছে, তাদের সাধ্য আছে। ফলে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতাটা জরুরি। মানুষের সমস্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা জরুরি। সরকার কিছু বললেই তা চোখ বুজে মেনে নেয়া নয়, যুক্তি ও তথ্য দিয়ে খতিয়ে দেখাটা জরুরি। 

কিন্তু তা কি হয়? হয় না, বরং উল্টোটা হয়।  কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের প্রধানরা কিছু বললেই তা ভয়ংকর গুরুত্ব পায়। ক্ষমতাসীন দলের খবর সবচেয়ে গুরুত্ব পায়। না হলে? সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে যাবে। ভিটামিন এম যদি বন্ধ হয়, তাহলে সংবাদমাধ্যম টিকবে কী করে? আর তারপরেও এই নির্দেশের অন্যথা হলে, সরকার বিরোধিতা করলে কী হবে? তার উদাহরণ তো প্রচুর। পশ্চিমবঙ্গের একটি ইউটিউব সংবাদ চ্যানেল আরামবাগ টিভি-র সফিকুল ইসলামের বাড়িতে ভোর রাতে পুলিশ দরজা ভেঙে ঢোকে, তাকে ও তার স্ত্রীকে থানায় নিয়ে যায়, তার বিরুদ্ধে একগাদা মামলা দেয়। 

ন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ জার্নালিস্টস গত ১৪ ফেব্রুয়ারি একটি বিবৃতিতে বলেছে, ৯ ফেব্রুয়ারি নীতিন ওয়াঘলেকে একটি রাজনৈতিক দলের কর্মীরা মারধর করে। তার অপরাধ, তিনি ওই দলের শীর্ষনেতাদের বিরুদ্ধে একটি অনুষ্ঠানে কিছু বলেছিলেন। ১০ ফেব্রুয়ারি বড়া খবর বলে একটি চ্যানেলের এক সাংবাদিককে চারজন বাইক আরোহী এসে মারধর করে। তার মাথায় ১৫টি স্টিচ দিতে হয়। প্রায় প্রতিটি রাজ্যেই এই ধরনের ঘটনা কমবেশি আছে। 

এখন ইউটিউবসহ সামাজিক মাধ্যমের দুনিয়ায় সত্যকে মিথ্যা, মিথ্যাকে সত্য করা যে কতটা সহজ, তার জন্য একটা উদাহরণই যথেষ্ট। মুলায়ম সিং যাদব তখন বেঁচে। উত্তরপ্রদেশে নির্বাচনের আগে সামাজিক মাধ্যমে খবর ছড়িয়ে পড়লো, অখিলেশ তার বাবা মুলায়মকে মতবিরোধের জেরে চড় মেরেছেন। আগুনের মতো সেই খবর ছড়িয়ে গেল। মানুষ বিশ্বাস করলো। তার প্রভাব ভোটের বাক্সে পড়লো। অথচ সেই খবর ছিল সর্বৈব মিথ্যা। অথচ সেই মিথ্যাকে সত্য করে দেয়া হয়েছিল। অখিলেশের কথায় মানুষ কান দেয়নি। 

এই সত্যকে মিথ্যা করে দেয়া, মিথ্যাকে সত্য, এই গুরুত্বপূর্ণ খবরকে গুরুত্বহীন করে দেয়া, গুরুত্বহীনকে গুরুত্বপূর্ণ, এই সময়ে সাংবাদিকতা করাটাও কঠিন। এখানে সাংবাদিকতা মানে সৎ সাংবাদিকতা, ভয়হীন সাংবাদিকতা, ঠিক কথা লিখলে বা বললে, শাস্তি না পাওয়ার সাংবাদিকতার কথা বলছি। সেরকম কি নেই? অবশ্যই আছে। রাভিশ কুমার-সহ অনেক উদাহরণ আছে, যারা প্রতিদিন নিজের মতো করে ভয়হীনভাবে সাংবাদিকতা করছেন। ঘটনা হচ্ছে, সকলে তো রবিশ কুমারদের মতো জনপ্রিয় নন, যারা চাকরি ছেড়ে নিজেদের উদ্যোগে ইউটিউব চ্যানেল করে টিকে থাকতে পারবেন। 

তারপরেও ছোট-বড় অনেক সাংবাদিক আছেন, যারা এই কাজটা যত্ন করে করার চেষ্টা করছেন। গদি মিডিয়া, ধামাধরা মিডিয়ার বাইরে থাকার চেষ্টা করছেন। ভারতে সরকারের ধামাধরা মিডিয়াকে গদি মিডিয়া বলে। দিল্লির সীমানায় যখন কৃষকরা এসে বসেছিলেন, তখন তারা বোর্ডে লিখে জানিয়ে দিয়েছিলেন, গদি মিডিয়ার তাদের খবর দেখানোর দরকার নেই। কারণ, তাদের অভিযোগ ছিল, গদি মিডিয়া সরকারের পক্ষ নিয়ে তাদের আন্দোলনকে দুর্বল করার জন্য প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। এই গদি মিডিয়ার বাইরে গিয়ে এক নয়, দুই তরফের কথাই বলার চেষ্টা করছেন এমন সাংবাদিকও আছেন। তারা প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার চেষ্টা করছেন। তারা সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলার চেষ্টা করছেন। সেটা করতে গিয়ে তাদের প্রতি কটূক্তি, গালাগালির বন্যা বয়ে যাচ্ছে। বিদ্রুপের কষাঘাতে চুপ করিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছে। কিন্তু তারা তারপরেও নিজেদের কথা বলছেন, খবর করছেন। 

আর একটা কথা মনে রাখা দরকার। সাংবাদিকতার মশাল কখনো নেভে না। অনেক ঝড়ঝাপটা পেরিয়েও তার শিখা অনির্বাণ। বিভিন্ন সময় তার সামনে চ্যালেঞ্জ এসেছে। গেল গেল রব উঠেছে। সে সব ঝড়ঝাপটা কেটেও গেছে। এই সংকটও কাটবে, কাটবেই। হয়ত ঠেকে শিখবেন মানুষও। গণতন্ত্রে কোনো একতরফের কথা নয়, সব পক্ষের কথা শোনা দরকার। আমরা ওরার কোনো স্থান গণতন্ত্রে নেই। খবরের দুনিয়ার চরমপন্থা নিন্দনীয়। তারা যত তাড়াতাড়ি এটা বুঝবেন, ততই মঙ্গল, ততই সবপক্ষের কথা তাদের কাছে পৌঁছাবে। তারা সব দেখেশুনে নিজের মতামত গঠন করবেন। অসহিষ্ণুতা দিয়ে নয়, যুক্তি দিয়ে।